2012-01-08

বাংলা চটি-----'অজ্ঞাতনামা'

 




 টাই এর নট'টি ঠিক করতে করতে ডাইনিং টেবিলে এসে পাউরুটিতে কামড় দিয়ে সংবাদ পত্রটি চোখের সামনে তুলে ধরে মিজান। বড় বড় অক্ষরে লাল কালিতে লেখা "বাসের ধাক্কায় অজ্ঞাতনামা তরুনীর মৃত্যু"। অশ্রাব্য একটি গালি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে মিজানের। দেশটার হয়েছে কি? আর সাংবাদিকরাও অন্যকোন সংবাদ পায়না। সকালে উঠেই মৃত্যু সংবাদ দিয়ে দিন শুরু করতে হয় প্রতিদিন। এ থেকে কি আমাদের কোন পরিত্রান নেই? মৃত্যুটাই যেন স্বাভাবিক আর বেচে থাকা হচ্ছে অলৌকিক। অন্য হেডিংয়ের দিকে নজর দেয় মিজান। আজ মানবাধিকার দিবস। প্রধান মন্ত্রী দিবসটি উদ্ভোধন করে ফিতা কাটবেন ওসমানী মিলনায়তনে। চা'য়ের কাপটি মুখে তুলে পেপারটি ঘুরিয়ে ধরে নীচের হেডিং দেখার জন্য। হঠাৎ চোখ আটকে যায় একটি ছবির উপর। বাসের ধাক্কায় যে অজ্ঞাতনামা তরুনীর মৃত্যু হয়েছে তার বিভৎস একটি ছবি ছেপেছে। বড় বড় দুটি চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। বুকের নীচের অংশের উপর দিয়ে বাসের একটি চাকা চলে গেছে। কিন্তু মুখের কোন ক্ষতি হয়নি। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। মিজানের হাত থেকে কাপটি পড়ে যায়, ধপাস করে বসে পড়ে চেয়ারে।

২০০১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী। বিশ্ব ভালবাসা দিবস। মিজান ইচ্ছে করেই টিএসসি'র সামনে সোহওয়ার্দী উদ্যানের একটি বেঞ্চিতে বসে উদাস মনে ভাবছিল ওর অতীতের কথা। হঠাৎ তিনটি মেয়ে এসে ওর ধ্যান ভঙ্গ করে দিল। রিনা, পলি ও ছবি। নিজেদের পরিচয় দিয়ে ওর সাথে আলাপ করার পার্মিশন চাইলো রিনা। না চাইতেই প্রাপ্তিতে মিজান খুশি। বিনয়ের সাথে ওদের আমন্ত্রণ জানায় মিজান। রিনা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ে। পলি ওর বান্ধবি আর ছবি খালাতো বোন। কুমিল্লায় বি.এ পড়ে, বেড়াতে এসেছে। ওদের বিস্ময়ের কারণ হলো এমন একটি দিনে মন খারাপ করে কেউ উদাস হয়ে বসে থাকবে, এটা ভাল দেখায় না। তাই ওরা ওকে সংগ দিতে চায়। অদ্ভুত একটি প্রস্তাব। এমন মানুষও আছে আমাদের দেশে? মিজানের ভাললাগে ওদের কথা। কিছুক্ষনের মধেই ওরা গল্পে গল্পে মেতে উঠে। একের পর এক চলতে থাকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানো আর খানাপিনা। মিজান ওদের খরচ করতে দেয়না। বিদায়ের আগে ছবি ওর খোপা থেকে একটি ফুল খুলে মিজানের দিকে এগিয়ে দেয়। মুখে কিছু বলে না ছবি। কিন্তু মিজান ওর চোখে দেখতে পায় মফস্বল শহরের একটি সহজ সরল মেয়ের নিষ্পাপ মনের ছবি। মিজান ওর চরিত্রের বিশেষ রূপটি সামনে এনে বিনয়ের সাথে বলে তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমার ঠিকানাটা আমায় দেবে? ছবি একটুকরো কাগজে ওর ঠিকানা লিখে মিজানের হাতে দেয়।

মিজানই প্রথম চিঠি লিখে ছবিকে। ছবি চিঠির উত্তর দেয়। এভাবে চলতে থাকে ওদের চিঠির মাধ্যমে নিজেদের জানাজানি। মিজান প্রতিটি চিঠিতে এমন কিছু শব্দমালা গেথে পাঠায় যে, ছবি ধীরে ধীরে ওর প্রতি দূর্বল হতে থাকে। মিজানের প্রতি ছবির শ্রদ্ধা ক্রমেই বেড়ে যায়। বড় ভাইয়ের আসনে বসিয়ে ছবি প্রতিটি চিঠিতে 'ভাইয়া' বলে সম্বোধন করে মিজানকে। বিনিময়ে মিজান ওকে ডাকে 'বন্ধু' বলে। ওদের দুজনের বয়সের পার্থক্য প্রায় ১৫ বছর। চিঠির ভাজে ভাজে থাকে সুন্দর সুন্দর উপদেশ বাণী আর একটি করে ছোট গল্প। এই সময়ের মধ্যে ওরা দুজনেই যেন এক নেশার ঘোরে ডুবে যায়। চিঠি পেতে দেরী হলে ওরা অস্থির হয়ে উঠে। মিজানের নিজের একটি অফিস আছে মতিঝিলে। সেখানে দিনের বেশীরভাগ সময় ব্যয় করতে হয়। তার মাঝেও ছবির চিঠির জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

ছবির ফাইনাল পরীক্ষা হয়েগেছে। বরপক্ষ আর দেরী করবে না। ছবির অনেক আগেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বিদেশে কর্মরত এক ছেলের সাথে। গত সপ্তাহে ছেলে দেশে ফিরেছে। এবার ছবিকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে। মিজানও জানে ছবির বিয়ের খবরটি। তবে আগামী সপ্তাহেই যে বিয়ে হবে তা জানে না। ছবি ঢাকায় এসেছে মিজানকে সারপ্রাইজ দিতে। কিছু কেনাকাটা করবে আর মিজানকে বিয়ের সংবাদটি নিজে মুখে বলবে।

সরাসরি মিজানের মতিঝিলের অফিসে এসে উপস্থিত হয় ছবি। পিয়ন এসে ভিতরে যাওয়ার জন্য ছবিকে দরজা খুলে দেয়। ছবি মিজানের রুমে প্রবেশ করে। ১৪ ফেব্রুয়ারীর পর এই প্রথমবার দেখা ওদের। ছবি দুরু দুরু বুকে চরম উত্তেজনা নিয়ে মিজানের দিকে তাকায়। মিজান ছবির দিকে বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষন কেউ কোন কথা বলতে পারে না। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে মিজান চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ছবিকে জড়িয়ে ধরে। স্থান কাল ভুলে গিয়ে আবেগে পাগলের মত ছবিকে চুমু খেতে থাকে। এমন একটি পরিস্থিতির কথা ছবি কল্পনাও করেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় ছবি কিছুই করতে পারে না। কিছুক্ষন পর মিজান ওকে ছেড়ে দিয়ে বিনয়ের সাথে বলে- আই এ্যাম সরি, তুমি বস, আমি আসছি। এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ছবি পাথরের মুর্তির মত দাড়িয়ে থাকে। ওর কোন অনুভুতিই এখন কাজ করছে না। হঠাৎ করে কি হয়ে গেল তাও ভাবতে পারছে না। পিয়নটা এসে ওকে একটি কোল্ড ড্রি্কস দিয়ে যায়। ছবি হঠাৎ অনুভব করে ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

মিজান কিছু্কখন পর এসে বলে- চল বাসায় যাই। ছবির হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে হাত ধরে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। টেঙ্ক্যিাপে উঠে ওরা মিজানের বাসায় আসে। টেক্সিক্যপে ওদের কোন কথা হয় না। ছবি বোবার মত মিজানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। বাসায় এসে ছবিকে ড্রইং রুমে বসিয়ে ভিতরে চলে যায় মিজান। নিজের ড্রেস চেঞ্চ করে এসে ছবির পাশে বসে অফিসের ঘটনার জন্য বার বার ক্ষমা চাইতে থাকে। 'আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি ছবি। তোমাকে আমার দ্বিতীয় কোন সত্তা মনে হয়নি। মনে হয়েছে তুমি আমার আর একটি অঙ্গ।' ছবি মিজানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কিছুই বলে না। মিজান এবার ওকে স্পর্স করে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে চায়। আর এভাবেই আবার ছবিকে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে আদরে ভরিয়ে তোলে মিজান এবং পরিনতিতে যা হবার তাই হয়ে যায়।

মিজান নিজেকে ফ্রেস করে ছবিকে ফ্রেস হওয়ার জন্য তাগিদ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ছবি নিজেকে গুছিয়ে নিলে মিজান ওর হাতে ৫০০ টাকার চারটি নোট গুজে দিয়ে বলে তোমার পছন্দ মত সুন্দর একটি ড্রেস কিনে নিও। কিচেনে গিয়ে চায়ের পানি চড়িয়ে ফিরে এসে দেখে ছবি ঘরে নেই। টেবিলে ছড়িয়ে আছে ৪টি ৫০০ টাকার নোট। ঘরের দরজা খোলা।

সংবাদপত্রের ছবির দিকে তাকিয়ে মিজান চিৎকার করে বলে উঠে 'ও অজ্ঞাতনামা নয়, ওকে আমি চিনি। ও আমার ছবি'। গরম চা পড়ে ওর প্যান্ট সার্ট ভরে গিয়েছিল। মিজানের বিবেক সামনে এসে দাড়ায়। চিৎকার করে বলে-ছবিকে তুই খুন করেছিস। তোর জন্য একটি নিষ্পাপ মেয়ে চলে গেল এই পৃথিবী থেকে। তোর কোন ক্ষমা নেই। তুই খুনি।

গরম চা প্যান্ট ভেদ করে যখন বাহুতে পৌছে তখন মিজান বাস্তবে ফিরে আসে। মনে মনে বলে এমনতো কতই ঘটছে। কে কার খরব রাখে। পেপার খুললেইতো কত মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। তাতে পৃথিবীতো থেমে নেই। আমি ওকে চিনিনা। ও সত্যি 'অজ্ঞাতনামা'।

No comments:

Post a Comment